আরণ্যক : বই রিভিউ

 বই লেখক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়




'মানুষের বসতির কাছে কোথাও নিবিড় অরণ্য নাই। অরণ্য আছে দূর দেশে, যেখানে পতিত-পক্ব জম্বুফুলের গন্ধে গোদাবরী-তীরের বাতাস ভারাক্রান্ত হইয়া ওঠে, 'আরণ্যক' সেই কল্পনালোকের বিবরণ।'

লেখকের অরণ্যবাসের অসাধারণ বিবরণীতে মুগ্ধ হয়ে রইলাম কয়েকটা দিন। কলকাতা শহর ছেড়ে, সদ্য বিহারের ঘন জঙ্গলে জমিদারির ম্যানেজারি করতে যায় যুবক বিভূতিভূষণ। প্রথম প্রথম একাকীত্ব বোধ করলেও, সে একাকীত্ব ঘুচে যায় রহস্যময়ী‌ তরুণী নারীর মতো নিবিড় জঙ্গলের সম্মোহনে। 

ভারতবর্ষের এই অপূর্ব রূপসী বন-জঙ্গল বিভূতিভূষণের চোখে ধরা দিয়েছে অসংখ্য বিচিত্র রূপ নিয়ে। সূর্যাস্তের রূপ নিয়ে বিভূতিভূষণ লেখেন— 
'গাছের ও ঝোপের মাথায় মাথায় অস্তোন্মুখ সূর্য সিঁদুর ছড়াইয়া দিয়াছে' 
বসন্তের ফোটা ফুলের ঝাড় দেখে তার কল্পনায় আসে বাঙালি নারীর শাড়ি— 
'অজস্র ফুল একত্র দলবদ্ধ হইয়া অনেকখানি জায়গা জুড়িয়া দেখাইতেছে ঠিক বেগুনি রংয়ের একখানি শাড়ির মতন।' 
আবার গাছের ডালে সহস্র বকের মেলা দেখে লেখকের মনে হয় যেন— থোকা থোকা সাদা ফুল ফুটে রয়েছে। 

ভীষণই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বাস সেই জঙ্গলে। তাদের পৃথিবীটা যেন লবটুলিয়া বইহারের সীমানার মাঝেই শেষ। তাদের অদ্ভুত জীবনযাত্রা বিভূতিকে নাড়া দেয়। ভাত খাওয়া তাদের জন্য বিলাসিতা, কাশডাঁটায় বোনা খুপরিতে তাদের সংসার। অথচ তাদের অন্তরের প্রাচুর্য বিস্তীর্ণ বনের মতোই।‌‌ 

পরিচয় হয় ধাওতাল সাহুর সাথে। পেশায় মহাজন হলেও, 'মহাজন' জাতের কাঠিন্য নেই তার মাঝে। যে-কারো টাকার প্রয়োজন হলে ধার দিচ্ছে বিনা বাক্য-ব্যয়ে, শোধ করার জন্য কোন তাগাদা নেই, সুদ পরিশোধ না করলেও চলে। আর তার পোষাক ক্ষেতে-খাটা কৃষকের মতোই মলিন, তার ব্যবহার অসম্ভব বিনীত। বিভূতি একবার তার কাছে টাকা ধার নেয়। পরের বিবরণটুকু এরকম— 
সেদিন যে-টাকা ধাওতাল সাহুর নিকট হইতে আনিয়াছিলাম, তাহার শোধ দিতে প্রায় ছ'মাস দেরি হইয়া গেল—এই ছ'মাসের মধ্যে ধাওতাল সাহু আমাদের ইসমাইলপুর মহলের ত্রিসীমানা দিয়ে হাঁটে নাই, পাছে আমি মনে করি যে সে টাকার তাগাদা করিতে আসিয়াছে। ভদ্রলোক আর কাহাকে বলে! 

দেখা পাই যুগলপ্রসাদের সাথে। লোকে তাকে বলে পাগল। তার পাগলামো হলো—অচেনা অজানা ফুল, লতা সংগ্রহ করে সারা বনময় রোপণ করা। না খেতে পাওয়া, অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝে অমন সৌন্দর্যপিপাসু মন! 

কিশোর বালক ধাতুরিয়ার মাঝে দেখি শিল্পী মন। পাড়ায় ঘুরে ঘুরে লোককে দেখায় তার 'ছক্করবাজি' নাচ। কলকাতায় গিয়ে নাচ দেখানোর কথা চিন্তা করে চকচক করে ওঠে বালকের চোখ। 

পাহাড়ি ষোড়শী ভানুমতী।‌ তার ছেলেমানুষি আর নিঃসঙ্কোচ ব্যবহার অভিভূত করে বিভূতিকে- 
ভানুমতীর মধ্যে যে আদিম নারী আছে, সভ্য সমাজে সে-নারীর আত্মা সংস্কারের ও বন্ধনের চাপে মূর্ছিত। 

সেই জঙ্গল বিলুপ্ত হয়ে গেছে কতো কাল আগে, ইট-কাঠের দালানে বাস করে, বিভূতির লেখা ছাড়া তার সাথে কখনো পরিচয় হতো কিনা জানিনা। ক'টা দিন বেশ গেল— সরষে ফুলের সুবাস, নীলগাইয়ের দৌড়, বুনো মহিষের দেবতা 'টাড়বাড়ো', কাশডাঁটায় বোনা চাটাইয়ের উপর শুয়ে স্বপ্ন দেখা জনপদ— কতো বিচিত্রতার সাথে মিশে ছিলাম। মনটা কেমন করে উঠছে এসবের জন্য...

Comments

Popular Posts