চৌরঙ্গী - বই রিভিউ
লেখক: শংকর
"Wealth, women and wine can make anything happen in this world."
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কেটে গেল কয়েকটা দিন। চৌরঙ্গী পড়তে পড়তে। চৌরঙ্গীর শাজাহান হোটেলটা যেন পৃথিবীর একটা স্যাম্পল, এমন একটা স্যাম্পল যেখানে সমাজের বিত্তবানরা পায়ের ধুলো দেন, বিত্তকে এক্সচেঞ্জ করেন নারীর মোহে কিংবা আকণ্ঠ মদে।
শাজাহান হোটেলের রিসেপশনিস্ট এর চোখ দিয়ে এ যেন পৃথিবীরই এক সারসংক্ষেপ। লেখার ভঙ্গি এমন— পাঠক নিজের অজান্তেই কখনো শাজাহান হোটেলের বারে, কখনো রেস্তোরাঁয়, কখনো দুই নম্বর সুইটে বিহ্বল হয়ে উপভোগ করছে রঙ্গমঞ্চের দৃশ্য।
ষাট শতকের চৌরঙ্গী আরো পুরনো ইতিহাসকেও টেনে এনেছে। কলকাতা তখন কেবল ব্রিটিশ মুক্ত হয়েছে। কিন্তু তার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ততক্ষনে পাশ্চাত্যের কালচার স্থায়ী বাসা বেঁধে ফেলেছে। আমরা তখন কেবল বিলিতি নেশায় মত্ত হতে শুরু করেছি।
ডিম্পল স্কচ, হোয়াইট লেডি, প্যারাডাইস, সিলভার গ্রেড, মস্কো মিউল, ম্যানহাটান ককটেল, স্পার্কলিং রেড হক— দারুণ আকর্ষণীয় নামের মদগুলো সাথে পরিচয় হওয়া খুব জরুরি, সমাজের উঁচু শ্রেণীর কাতারে দাঁড়াতে গেলে।
বক্ষে সুধা এবং হস্তে সুরাপাত্র নিয়ে ইংলন্ডের অষ্টাদশীরা সুয়েজখাল কাটার পর থেকেই কলকাতায় আসতে লাগলেন।
হে মিস্, হুইস্কি সরাব, ব্লাতি পানি লে আও— ভীষণই ডিমান্ড কাস্টমারদের।
কলকাতা আধুনিকতাকে ধারণ করলো, কিন্তু সে কেবল সন্ধ্যে সাতটা থেকে রাত বারোটার জন্য।
শাজাহান হোটেলের বারে তোমার এই মিষ্টি হাসি দেখবার জন্য যাঁরা সাধ্যসাধনা করেন, রাস্তায় বেরিয়ে তারাই অন্য মানুষ হয়ে যান। তাঁদের সমাজ আছে, হিন্দুদের থেকেও কড়া সামাজিক আইন আছে, সেখানে রাত-জেগে-মদ-বিক্রি-করা মেয়েদের কোন স্থান নেই।
চৌকাট লেখনিতে শংকর কটাক্ষ করেছেন এই পৃথিবীকে—
সেদিন মনে হয়েছিল, বিধাতার সৃষ্টি-পরিকল্পনায় পুরুষকে তিনি অনেক ভাগ্যবান করে সৃষ্টি করেছেন। নারীর স্রষ্টা যে-বিধাতা, তিনি আর যাই হোন, সমদর্শী নন।
বাইরে এসে দেখলাম, আরও গাড়ি আসছে। বুড়ো গাড়ি থেকে ছোকরা নামছে, ছোকরা গাড়ি থেকে বুড়ো নামছে। পুরুষ কলকাতার নির্যাস যেন আমাদের এই শাজাহান হোটেলে ভিড় করছে। আর, আমরা সেখানে বসে আছি যার দু'মাইল দূরে একদা রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অরবিন্দ, সুভাষচন্দ্র ভারত সন্ধানে আত্মনিবেদন করেছিলেন। উইলিয়ম জোন্স প্রাচ্যবাণীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ডেভিড হেয়ার ছেলেদের লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন।
"নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়
লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।
তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব—অতিবৈতনিক,
বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবশত।"
নাচের প্রাগৈতিহাসিক ছন্দ যেন দামামা বাজিয়ে রাতের অতিথিদের অন্তরের পশুটাকে জাগিয়ে তুলছে। বাধাবন্ধহীন সে অরণ্য শক্তির কোট-প্যান্ট-টাই-এর খাচা ভেঙে এই মুহূর্তেই বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
"ভগবান? ওর নাম করবেন না, মশাই। ঘেন্না ধরে গিয়েছে। উনিও আরেক গবরমেন্ট। ঠিক গবরমেন্ট অফিসের মতো ওঁর কাজ কারবার। ওরঁ আপিসে যদি কোনোদিন যান, দেখবেন হাজার হাজার পিটিশন রোজ এসে জমা হচ্ছে। ভগবানের কর্মচারীরা সব 'নো অ্যাকসন, মে বি ফাইলড' লিখে ফাইলে ঢুকিয়ে রাখছে। কস্মিন্ কালে কেউ কোনোদিন সে-সবে হাত দেয় না।"
এই জায়গাটা পড়ে কেন জানি মনে পড়েছিল পদ্মানদীর মাঝি'র ওই ডায়লগটা— ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্রপল্লিতে, এখানে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বইটা নিয়ে জেনেছিলাম গুডরিডসে রিজাল ভাইয়ের আপডেট দেখে। ঘাটাঘাটি করে মনে হলো, এ বই ভালো না হয়ে যাবে না। এক মাসের প্রতীক্ষা শেষে বই এসে পৌঁছুলো আমার হাতে। তারপর সময় কেমনে কেটে গেল। শেষের দিকে খানিকটা বিষণ্ণ বোধ করছিলাম, প্রিয় বই শেষ করতে মন চায় না।
কনি 'দ্য উয়োম্যান' এর কথা মনে থাকবে, মনে থাকবে সরাবজি'কে, সাদারল্যান্ডের ভারত ভ্রমণ, ন্যাটাহরিবাবুর এক্সট্রা বালিশ, মনে থাকবে স্যাটা বোস নামের একজনার সত্যসুন্দর ব্যক্তিত্ব।
প্রিয় আরেকটা কোটেশন দিয়ে শেষ করি—
কর্পোরেশনের বিনা পয়সার বিতাড়িত আলো শালপাতার উপর এসে আটকে গেছে। তার তলায় অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারেই যেন ঘুমিয়ে রয়েছে আমার ভারতবর্ষ।
Comments
Post a Comment