খুচরো লগন




পৌষের এক বিকেলে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বের হলাম শহরের দিকে। রাস্তায় কোনো তিন চাকার গাড়ি চোখে পড়লো না। আমি অপেক্ষা না করে হাঁটা দিলাম। মন চাইছিল হাঁটতে, গাড়ি-ঘোড়া দেখলে বরং দ্বিধায় পড়তে হতো— হাঁটবো, নাকি গাড়িতে বসে গাড়ির শ-শ শব্দের ভেতর ডুবে শহরটাকে দেখতে দেখতে যাবো। 


পথের মধ্যে দেখি একটু দূরে দূরে জংলি ফুলের গাছ। কি ছোট ছোট ফুল। সাত-আটটা ফুল মিলে একটা করে দল। দলের মাঝে ফুলগুলো হলুদ, বাইরের গুলো বেগুনি। বড় অবহেলায়, রাস্তার ধুলো মাখা ফুলগুলির খোঁজ করে না কেউ, তবু তারা হলুদে-বেগুনিতে মিশে এক পথচারীকে শোনাল গান— বসন্ত এসে গেছে... 


সেই বসন্তের গান রেখে আবার হাঁটা দিলাম। বেশিক্ষণ না যেতেই পু-উ-উ ঝিকঝিক.. ঝিকঝিক.. আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে গেলাম। লোকের ভিড় নেই আশেপাশে। চোখ খানিকটা আধাবোজা করে আমি শব্দটাকে অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করাতে চাইলাম। পৃথিবীটা এন্ড্রয়েড ফোনের ভার্সন এর মত আপডেট হচ্ছে রোজ, অথচ রেলগাড়ি অতীতের স্বাক্ষ্য রেখে ছুটে চলছে। বড় প্রিয় রেলের এই শব্দ। একই সঙ্গে সে মন্ত্র দেয় সামনে ছুটে যাওয়ার, আবার মন্ত্র দেয় অতীতে ফিরে আসার। 


হাঁটতে হাঁটতে শহীদ মিনার চলে এলো। মিনারের পেছনে এক যুগল, দূর থেকে দেখে মনে হলো মনোমালিন্য হয়েছে খুব। নির্মলা পৃথিবীতে টক্সিক বলতে শুধু বুঝি এই মনুষ্যকুল এ "কমপ্লেক্স রিলেশন"। 


এবার একটা রিকশা সে আমার দু'পায়ের বড়োই উপকার করলো। বেলা ডোবার আগে শহরে যাওয়া চাই, এমন ক্ষণে ক্ষণে থেমে থেমে রোমান্টিক চোখে সব দেখলে হবে? তা আমায় বড় উপকার করলে তুমি, যন্ত্রচালিত রিকশা। 


বিকেলবেলা শহর তেমন গমগমে হয়নি এখনো। মনে হচ্ছিল শহরটা একটা বই হয়ে গিয়েছে। পাতা মেলে দিয়েছে আমার সামনে। বলছে আমায়, কোথায় যাচ্ছ শহরবাসী, একটু থেমে আমায় পড়ো। কিংবা বলছে, লিখো আমায় নিয়ে, আমার অশুদ্ধ বাংলায় কথা বলা মানুষগুলো নিয়ে, আমাকে ঘিরে যে চায়ের স্টল চটপটি-ফুচকার দোকানের সমাগম নিয়ে। নাকি আমায় তোমার মনেই পড়ে না! বুঝি বিদেশ-বিভূঁইয়ে গেলে স্মৃতির অ্যালবাম থেকে বের করবে শুধু আমায়। 


আমার বুকে ছুটে চলা রেলের শব্দ, হঠাৎ কা করে ডেকে ওঠা কাক, কখনো পেয়ারা-মাখা, কখনো ছোলাবুট, শীতের সিজন এলে ভাপা পিঠার স্টল। কখন তোমার মনের মধ্যে আমি জাল বিছিয়ে ঘাপটি মেরে বসলাম, তুমি টেরও পেলে না।


Comments

Post a Comment

Popular Posts