নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে - বই রিভিউ

বই: নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে

লেখক: অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়





রবি শংকরের একটা প্রভাত-রাগ আমার বড় প্রিয়, বেশ ধীর লয়ে এর শুরু, নিঃশ্বাসের তালটা কেমন কমে আসে সেই রাগ শুনলে। তারপর তরী যেমন মাঝ-নদীতে পৌঁছালে, চারিদিকে উত্তাল, মনে হয় এখানে অস্তিত্ব শুধুই নদীর, তেমনি সেই রাগ বক্ষে আছড়ে পড়ে। 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে' বইয়ের সাথে এই রাগটার তুলনা চলে। শব্দের ঝংকারে প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনা, গ্রাম বাংলার মাটি ও মানুষ, বাঙালি পরিবারের আচার অনুষ্ঠান- এসব সোনা-রোদ-মাখা স্নিগ্ধ বর্ণনা থেকে অতীন বাবু পাঠককে নিয়ে আসেন এক মাঝ-নদীতে— যে নদী উত্তাল স্লোগান আর ইশতেহারে- লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, ভারতমাতা কী জয়, বন্দে মাতরম, নারায়ে তকদির।‌ মনে হয় বেলা পড়ে গিয়ে সোনা-মাখা-রোদ হারিয়ে গেছে, এখন চারিদিকে নেমেছে কুয়াশা। শব্দ দিয়ে যদি উচ্চাঙ্গ সংগীত লেখা হতো বাংলার প্রকৃতি ও ইতিহাস অবলম্বনে, তবে তাই হতো অতীন বাবুর 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে'। 


উপন্যাসের পরিধি বিস্তর। সোনালী বালির নদীর চরে উপন্যাসের পটভূমি। নদীর মাঝে মাঝে বসতি কিছু হিন্দু পরিবার ও মুসলিম পরিবারের। তাদের ভাষা এক, ধর্ম ভিন্ন, উৎসব অনেকটা মিলমিশে। তাদের আবহমান নিজস্ব জীবনধারা। বর্ষা এলে গয়না নৌকার মাঝি, শীতে নদীর চরে চাষবাস, দু'মুঠো অন্নের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম, অন্ন না মিললে নদীতে ডুবে ডুবে শালুক তুলে এনে তাই সেদ্ধ করে খাওয়া, তাই যেন অমৃত। অশিক্ষিত মানুষ, পুরুষশাসিত সমাজ। 


উপন্যাসের চরিত্রগুলো দাগ কেটে দেয় মনের ভিতরে। এক সোনা, ন'-দশ বছরের বালক। সোনা বাবুর গায়ে চন্দনের সুবাস। তার পিছু মাঠময় ছুটে বেড়ায় ফতিমা। ফতিমার পায়ে মল, নাকে নোলক। এক ঈশম, ঠাকুর পরিবারের জন্য খাটছে সারাদিন। জালালি, জোটন হিসাব করছে অন্নের। মালতি— তরুণী বিধবা, শীতের ভোরে সে ডুব দেয় পুকুরে, শরীরের জ্বালা যেন ফেলে আসতে চায় সেখানে। আর আছেন এক পাগল ঠাকুর, জীবনের ছন্দ যেন তার কবে কেটে গেছে। তবু খুঁজে বেড়াচ্ছেন পুরনো ছন্দ, হাতে তালি দিচ্ছেন, কোথায় তুমি, এসো  নীলকন্ঠ পাখি। 


ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে দিয়ে উপন্যাসটা গড়িয়ে নিয়েছেন অতীন বাবু। শীতের কালে মুড়াপাড়া থেকে হাতি আসে এই গ্রামে। আসে আরো কত ইস্তাহার- 


এই হাতি বাড়ির উঠোনে উঠে এলে জমিতে সোনা ফলবে। ওরা হাতির মাথায় কপালে লেপে দেবার জন্য সিঁদুর গুলতে বসে গেল। হাতিটার কপালে সিঁদুর দিতে হবে, ধান দূর্বা সংগ্রহ করে রাখল সকলে। আর মালতি দেখল, হাতির পিঠে পাগল মানুষ হাততালি দিচ্ছেন। হাতির পিঠে সোনা। ফতিমা সোনাবাবুকে নিচ থেকে বলছে, আমারে পিঠে তুইলা নেন সোনাবাবু। ফতিমা হাতির পিঠে ওঠার জন্য ছুটছিল। আর তখন ফতিমার বা'জী সামসুদ্দিন সামিয়ানার নিচে বড় বড় অক্ষরে ইস্তাহার লিখছিল, ইসলাম বিপন্ন। বড় বড় হরফে লিখছিল—পাকিস্তান জিন্দাবাদ। 


কখনো বর্ণনায় ব্যবহার হয়েছে গ্রামের মানুষের মুখের ভাষা। 


হোগলার জঙ্গলে দুটো সাদা পা, কী সুন্দর আর যেন দুর্গাঠাকুরের পা। ওর বুকটা কেঁপে উঠলো। ... তরে নিয়া আইছে কে!


দুগগাঠাকুরের পা দু'খান য্যান ভৎসনা করছে কাকে, কিসের এক বিশ্বাসঘাতকতা। 


এমনি সময়ের স্রোতে আমাদের মিলমিশে গ্রামে আসে নতুন ইস্তাহার। দেশ ভাগ হইবো। ভাঙনই তাইলে সই। 


দ্বিতীয়বার পড়লাম এই উপন্যাসটি। প্রথমবার যখন পড়ি তখন আমার রিডিং ম্যাচুরিটি তেমন ছিল না। কিন্তু কেমন আকর্ষণ বোধ করছিলাম আর বইটা পড়া শেষ হলে মনে হয়েছিল যে, এরকম কিছু আগে কখনো পড়িনি। দ্যাট ওয়াজ আ টার্ন অফ মাই রিডিং যার্নি। দ্বিতীয়বার পড়লুম মাত্র। আবারো ফিরে আসবো, কোনো সোনা-রোদ-মাখা সকালে উল্টাবো পাতা- নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে





Comments

Popular Posts