বই রিভিউ/মানুষের ঘরবাড়ি

 বই লেখক: অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় 



'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে' সিরিজ লেখার পর অতীন বাবুর মনে হলো, জীবনের আসল পর্বটা বাদ পড়ে গেছে সিরিজ থেকে। সেই পর্বটা পরবর্তীতে লিখে সিরিজের মাঝে আনা হয়। প্রথম পর্বের চরিত্ররা এ পর্বে অনুপস্থিত। সোনা এ পর্বে ঘুমিয়ে আছে বিলুর মধ্যে। 

নামটাতেই অভিমান জড়িয়ে আছে। মানুষের ঘরবাড়ি থাকে। আমাদের তাও নেই। দেশভাগের পর ছিন্নমূল এক পরিবারের সংগ্রাম শুরু হয়। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে যাত্রা। বিনা টিকিটে। আজ এখানে, তো কাল সেখানে। এক সময় তারা দুবেলা পেটপুরে খেয়েছে, গোলাভরা ধান,‌ গাই-গরু কিছুরই অভাব ছিল না। এদেশে এসে তাদের শেষ সম্বলটুকু ক্ষুধার নিমিত্তে আহারে পরিণত করতে হয়েছে। আর বাকি সম্বল‌ এটুকুই—তারা সৎ ব্রাহ্মণ। 

পরিবারের বড় ছেলে বিলু। উপন্যাসের একটি বড় খন্ড বিলুর ভাস্যে বর্ণিত। বয়সন্ধিকালে আত্মসম্মানবোধ সবার মধ্যে বেশি কাজ করে। পরিবারের আর্থিক অবনতি, জলে পড়ে যাওয়া, তারা যে আত্মীয়র বাড়িতে আশ্রিত, এদেশের মানুষের কাছে রিফুজি, বারো-তের বছরের বিলুর মনে তা ভীষণ পীড়া দেয়। 

ঘুরেফিরে একসময় ঘরবাড়ি মেলে তাদের। দারুণ গর্বের বিষয় ছিন্নমূল পরিবারটির জন্য। থাকা খাওয়া হলে তখন বড় ছেলেটির পড়াশোনায় মন দিতে হয়। বিলুর আলাদা একটা জগত গড়ে ওঠে পরিবারের বাইরে। 

বাবা সরল মানুষ- কার বাড়িতে ঠাকুর পূজা, কোথায় বামুন ভোজের জোগাড় চাই- এসব করে তার দিন যায়। মা বড্ড সাংসারিক- বাগানের বাড়তি সবজিটুকু, গরুর দুধ, হাঁস-মুরগির ডিম বেঁচে যা সামান্য আয়, তা থেকে সঞ্চয়। একসময় সবই হয়ে যায়- ঘরবাড়ি হয়, দুটো তক্তপোশ, বাইরের ঘরে একটা জলচৌকি। বড় পুত্র মাধ্যমিকে দশটা বিষয়ের নটাতে পাশ। জীবনে কে কবে সব বিষয়ে পাশ করে। নিম্নবিত্ত থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত হওয়ার আশাবাদী যাত্রা। 

শহর ঘুরে আসে বিলু। পরিবারের আচার-আচরণে যথেষ্ট সচেতন সে। বিব্রত হয় ভাইয়ের খাই খাই স্বভাবে, বাবা-মায়ের সীমাহীন পুত্রগর্বে। কৈশোর তারুণ্যের মাঝামাঝি সময়টাই বুঝি এমন। বড্ড ছোট মনে হয় তখন পরিবারের গণ্ডিটা। যে পরিবার থেকে বেড়ে ওঠা তার জন্যই বিব্রত হওয়া। ভিতরে তাদের জন্য যে গভীর টান, তা প্রকাশ করতেও কুন্ঠা। 

ছিন্নমূল পিতার সন্তান—যেকোনভাবে পারি তার থেকে পরিত্রাণ চাইছি।

এভাবে বিলু বড় হয়। জীবনের একটা অচেনা পর্ব তার সামনে প্রকাশ হতে থাকে। বিলুর মাথায় ঘোরে ছোড়দি, লক্ষ্মী, পরী। ভালোই তো বেড়ে উঠছিল বিলু, তখনই জীবনের এই অদম্য পর্বে তার প্রবেশ। জানালায় তাকালে সে দেখে ছোড়দির নীল খাম, সাইকেলের ক্যারিয়ারে তাকে উঠিয়ে ছোড়দির দুরন্তপনা। অন্যমনস্ক হয়ে যায় বিলু জীবনের এই গোপন রহস্য অনুধাবন করতে। 

মাথার ভীষণ যন্ত্রণা কবিতায় রূপ নিতে থাকে। জীবনানন্দের সুর সেই কবিতায়। 

ভূমিকায় লেখক লিখেছেন খুব চাপ সৃষ্টি না হলে তাঁর লেখা হয় না। উপন্যাসের বিলু কি লেখক নিজেই— বন্ধুদের চাপে যে কবিতা লেখে। 

সিরিজের প্রথম পর্বটা সাত-আট বছর আগে পড়া। কিছুদিন আগে দ্বিতীয়বার পড়ি। অসম্ভব ভালো লাগার বই নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে। সেই সুর এসে পৌঁছেছে মানুষের ঘরবাড়িতে। বাবার হাতে বেড়ে ওঠে বাড়ির আমগাছটা, জবা ফুলটা, মা যত্ন করে রান্না করে ফুলকপির দোলমা, পাট পাতার বড়া, গিমা শাক ভাজি, বেগুন ভাজা, চালের পায়েস—সবকিছু অতীন বাবু মায়াবী এক সুরে গেঁথেছেন। আবার সতের-আঠার বছরের এক তরুণ, তার আত্মসচেতনতা, টানাপোড়েন, পরিবারের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া—বিচ্ছেদের সুরের মতো শোনাচ্ছিল। একটু একঘেয়ে লেগেছিল শেষের একটা অধ্যায়, কিন্তু এই রাগ যে ক্লাসিক্যাল—সে মত তাতে এতোটুকু পাল্টায়নি। 

অপেক্ষায় থাকলাম, তৃতীয় বই অলৌকিক জলযান এ চড়ে বসার।

Comments

Popular Posts