ঈশ্বরের বাগান: বই রিভিউ

 লেখক: অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় 





পৃথিবীপৃষ্ঠের পাঁচ ভাগের চার ভাগই জল। অলৌকিক জলযানে চড়ে সেই জল, সমুদ্র পেরিয়ে আমাদের ছোটবাবু অবশেষে ভিড়লো সেই একাংশ ভূমিতে, যেন ঈশ্বরের বাগানে। 


শৈশবে সোনা, কৈশোরে বিলু, জাহাজী জীবনে সে সোনাবাবু, যৌবনে থিতু হয়ে গেল শেষে এক টুকরো জমিতে, অতীশ দীপঙ্কর পরিচয়ে। এই বাগানের জীবন যুদ্ধে তার নানা ভূমিকা। বাবা-মায়ের মেজ সন্তান, দুই ছেলে মেয়ের পিতা, এক নারীর স্বামী, তাছাড়াও কারখানার ম্যানেজার, এভাবে সে বিভিন্নজনের অবলম্বন। 


একটা সময়, যখন সে ছিল ছোটবাবু, বনিকে সমুদ্র পার করে ডাঙ্গায় পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল তার, এখনো মনে হয় চারিদিকে সমুদ্রের মাঝে বোট নিয়ে ডাঙার সন্ধানে হাল ধরে আছে সে, কিন্তু এবার বোটে বনি নেই, এবার ডাঙায় পৌঁছে দিতে হবে মিন্টু, টুটুল, নির্মলাকে। সে জীবনে, জাহাজের কাপ্তান ছিল স্যালি হিগিনস, এখন জাহাজের কাপ্তান সে নিজেই। 


উপন্যাসের বিভিন্ন প্লটকে জোড়া দিয়েছে অতীশ । অতীশের সংসার যুদ্ধ দিয়ে আরম্ভ, তারপর এসেছে নীতির যুদ্ধ, কখনো বা ঈশ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ। সব যুদ্ধ সামাল দিয়ে অতীশ ফিরে গেছে সুদূর অতীতের স্মৃতিতে, আবার খুলেছে দেওয়া-নেওয়ার সেই জীর্ণ খাতাটা। মিলিয়ে দেখছে ঈশ্বরের এই বাগানে কার কতটুকু অধিকার, কারোই কি হার-জিত হয় এই যুদ্ধে? 


জীবিকার নিমিত্তে কলকাতা শহরে কারখানার ম্যানেজারের কাজ নেয় অতীশ। শৈশব কেটেছে যার সোনালি বালির নদীর চরে, অসীম সমুদ্র ও বিস্তৃত আকাশের মাঝে যার যৌবনের প্রাক্কাল, কলকাতা শহরের এই কড়ায়-গণ্ডায় জীবন তার কাছে কোলাহলের মতো লাগে। লেখার মাঝে এই কোলাহল, ফুটপাতের নোংরা আবর্জনা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ময়লার স্তুপে ঝুপড়ি গেড়ে পাগলের বাস; নগ্ন শ্বেতাঙ্গ নারী-মূর্তি, অয়েল পেইন্টিং এ সাজানো অভিজাত বসবার ঘর — দুয়ের মাঝে শুধু একটা প্রাচীর। দুজনে বেশ আছে দিব্যি। মাঝে মাঝে যখন নর্দমার মাছি সুগন্ধে ভরা অভিজাত ঘরে প্রবেশ করে, তখন দেখা যায় খানিকটা ত্রাস। 


জীবনের গতি প্রচন্ড এখানে। ব্যয়ের গতি যদি ছাড়িয়ে যায় আয়ের গতিকে, তবেই গন্ডগোল। এছাড়াও আছে সন্তানকে বড় স্কুলে ভর্তি করার প্রতিযোগিতা। বাইরের ঘরে একটা তক্তপোষ, শোবার ঘরে একটা বড় আয়না- এমনই বেড়েই চলেছে জীবনে অভাবের লিস্টি। কারখানার উপার্জন সীমিত, লেখালিখি থেকে হাতে একটা অংক আসে অতীশের। 


দেশভাগের এই চতুর্থ ও শেষ উপন্যাসে লেখক যেন আরো বেশি করে ব্যক্তিসত্তার মধ্যে ডুবে গেছেন। বলে দিতে হয় না এই অতীশ দীপঙ্কর যে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। উপন্যাসের নায়ক অতীশকে তিনি যতো পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন, সেসব নিজেই পার করে এসেছেন জীবনের বিভিন্ন অংকে। 


বিভিন্ন নারীকে পরিক্রমণ করে আমাদের এই উপন্যাসের নায়কের জীবন। যৌবনে সেই পরিক্রমণ আরও গভীর। তার সৌম্য চেহারা, নম্র আচরণ আকর্ষণ করে চারপাশের নারীদের। বহু নায়িকা তাই তার এই জীবন নামের উপন্যাসে। 


বারবার লেখক নারী-পুরুষের কামপ্রবৃত্তিকে তুলে এনেছেন। আমাদের এই উপমহাদেশে চায়ের টেবিলে আলোচনায় সে প্রসঙ্গ আসে না, অথচ মানুষের শরীরের রন্ধে রন্ধে যে গোপন আকাঙ্ক্ষা সূচ ফুটায় লেখক বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন। 


অথচ এত গোপন এই কর্মধারা, জীবনের চলাফেরায় তার কোনো অস্তিত্ব আছে মনে হয় না। কিংবা মুখোশ পরে থাকা সংসারে, আসলে সেই প্রবল ইচ্ছের তাড়নাতেই মানুষের এই ধর্মশাস্ত্র, বীজ বপন এবং আবাদ। 


বড় ভালো লেগেছে এই জায়গাটা। হাওয়াকে সৃষ্টি না করলে আদম কি সেই পাপে জড়াত? 


কুম্ভবাবুর চরিত্রটা নজর কাড়ে। আমিও যেন সংসারে এমন প্রচুর মানুষ দেখলাম। কর্তাব্যক্তিদের সাথে হে হে করে আলাপ করে যারা পকেটে টাকা গোছাচ্ছে। অত্যন্ত আপনার মতো ব্যবহার, কিন্তু কি, পকেটে টাকা পুরার গ্রিডি আলগরিদম ছাড়া মগজে আর কিছুই নেই। 


সংসার, দাম্পত্য ছাড়িয়ে উপন্যাস মোড় পাল্টায়। বিদেশি আলোকচিত্রের একটা প্রদর্শনী। অ আজার বালথাজার। ফরাসি চলচ্চিত্রটির কিছুই অনুধাবন করতে পারে না অতীশ। না পারলেও দর্শকসারিতে খুঁজে পায় অতীতের একটি দরজা। বর্তমানে কি অতীতের প্রশ্নের উত্তর মেলে। নাকি জীবনটাই সেই সিনেমার মতোন, অনুধাবনের অতীত। 


অ আজার বালথাজার। 


হিন্দুর বাড়িতে মুসলিম এর প্রবেশ বাড়ণ, আবার হিন্দু সম্প্রদায় কে ছাড়তে হলো দেশ। আমরা  কি কারো প্রতি সুবিচার করতে পেরেছি? যে ঈশ্বরের জন্য আমরা পরস্পরকে ঘৃণা করেছি, কোথায় পেয়েছি তার সান্নিধ্য... ধর্মভীরু পিতার সন্তান অতীশ। যৌবন ছুঁতেই তার ঈশ্বর বিশ্বাস ফেটে চৌচির। কুম্ভ বাবু আপনার তো ঈশ্বর আছে আমার তাও নেই। 

ঈশ্বরকে আমরা নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করি, হয়তো টের পাই না কতো বড় অবলম্বন সে আমাদের বেঁচে থাকার। জীবনের যাবতীয় টেনশন ঈশ্বরের কাঁধে ছেড়ে না দিলে, কতো অসহায় আমরা।

সেই ঈশ্বরই আবার আমাদের যুদ্ধের কারণ। 


ঈশ্বর আপনার জন্ম দিয়ে আমরা ঠিক করিনি। আপনি না জন্মালেই পারতেন ঈশ্বর। 


আবারো মোড় নেয় উপন্যাস। এই চূড়ান্ত মোড়ে অতীতের জালে ধরা দেয় অতীশ। 


আমি ভুলতে চেয়েছি। দেশের কথা ভাবলেই ক্ষোভে জ্বলে উঠতাম। তোরা আলাদা দেশ দাবি করলি! আমাদের মানুষ মনে করলি না। আমরা কোথায় যাব, কোথায় গিয়ে উঠব ভাবলি না। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। বাংলাদেশ, এমন সোনার বাংলা, তাকে পূর্ব-পাকিস্তান বানিয়ে ছাড়লি। ক্ষোভ হবে না! কেন আমাদের চলে আসতে হল। আমরা তোদের পর হয়ে গেলাম। একই জল মাটিতে নিশ্বাস ফেলেছি—বড় হয়ে উঠেছি, দেশান্তরী করে ছাড়লি! 


দেশভাগ স্তিমিত ছিল দ্বিতীয় ও তৃতীয় উপন্যাসে। এখানে অতীন বাবু সোনার শৈশবের সেই ভূখণ্ডকে আবার তুলে এনেছেন। এসেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম। হিন্দুদের তাড়িয়ে কি ভালো ছিল এ দেশ? বাঙালি ও পাকিস্তানি মুসলিমে কি ভাগাভাগি লাগেনি? 


এত ভাগাভাগি কেন মিঞা সাব! ভাগের শেষ আছে! যত ভাগ করবেন শরীর তত পঙ্গু হয়ে যাবে না? 


প্রায় শেষে চলে এসেছি আমরা। জীবনে শেষকৃত্যের কাছাকাছি হলে, সেই ঈশ্বরকে স্মরণ করি আমরা। সেই একি বানী উচ্চারিত হয় আমাদের মগজে, যাকে পৃথক প্রমাণ করার জন্য আমরা যুদ্ধ চালিয়েছি সারাটা জীবন। 


তারপর সর্বতোভাবে ফলন্মোথ অদৃষ্ট বশত প্রথমে জলময় সমুদ্র উৎপন্ন হইল। অতঃপর সেই জলময় সমুদ্র হইতে প্রকাশমান জগতের নির্মাণে সমর্থ ব্রহ্মা আবির্ভূত হইলেন। তিনি যথাক্রমে সূর্য ও চন্দ্র কে সৃষ্টি করলেন — তাহাতে দিন রাত্রি হইতে লাগিল। দিন রাত্রি হওয়ায় সংবৎসর সৃষ্টি হইল। অনন্তর ব্রহ্মা পৃথিবী, আকাশ, স্বর্গ এবং মহঃ প্রভৃতি লোকের সৃষ্টি করিলেন। 


কেমন করে তোমরা আল্লাহতে অবিশ্বাস কর, যখন তোমরা ছিলে মৃত আর তিনি করলেন জীবিত? পুনরায় যিনি তোমাদের মৃত্যু দেবেন, আর পুনরায় জীবিত করবেন, তখন ফিরিয়ে আনা হবে তোমাদের তাঁর কাছে। 



হাউ হি মাস্ট রিজয়েস ইন অল হিজ ওয়ার্ক। দ্য আর্থ ট্রেমবেলড্ অ্যাট হিজ গ্ল্যান্স। দ্য মাউন্টেনস বার্স্ট ইনটু ফ্লেম অ্যাট হিজ টাচ। ইউ উইল সিঙ টু দ্য লর্ড অ্যাজ লঙ অ্যাজ ইউ লিভ। ইউ উইল প্রেইজ গড টু ইয়োর লাস্ট ব্রেথ। 


উপন্যাসের শুরুটা হয় পাগল হাঁকছে দু-ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর। আবার ঠিক শেষে অতীন বাবু আমাদের এই দূরত্বের অংকটা মিলিয়ে দিতে চান। 


মা তুমি বড় বৃক্ষ। দাঁড়িয়ে আছ ডালপালা মেলে। ফুল ফোটে। ফল ধরে। হাওয়ায় কে কোথায় সব বীজ উড়িয়ে নিয়ে যায়। জল পড়ে। শস্য দানার মতো তারাও মাটির নিচে শেকড় চালিয়ে দেয়। বড় দূরের হয়ে যায় সব কিছু। সারা পৃথিবী জুড়ে কত গাছপালা, ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে তারও ফুল ধরে ফল হয়। আবার ঝড়ো হাওয়ায় বীজ উড়িয়ে কোন এক সুদূরে নিয়ে যায়। আমরা তোমার সেই বীজ উড়ে গেছি।


Comments

Popular Posts