গণদেবতা: Book review
Book author: Tarashankar Bandyopadhyay
১৯৫০ এর দশকে তারাশঙ্কর গণদেবতা বইটি লেখেন। বইটির সময়কাল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী দশক। শত বছরের পুরনো হয়ে যাওয়া গল্পটি পড়ছি আজ এসে। সেই শিবকালিপুর, পাশে ধনীদের গ্রাম কঙ্কনা, তাদের সীমানা কোথায় মিশে গেছে। কোথায় হারিয়ে গেছে চন্ডীমণ্ডপে জল দেওয়া, ইতুলক্ষ্মী পালনের আচার-আচরণ। হারিয়ে গেছে সেই মানুষদের বুলি। কতগুলো বাংলা শব্দের অর্থ আজকে আর বোঝার উপায় নেই, সে শব্দ ও সেই বস্তুগুলোর ব্যবহার হারিয়ে গেছে চিরতরে, তাদের জায়গা নিয়েছে যন্ত্রচালিত বস্তু, বিদেশী নামে। তারাশঙ্করের লিখিত সাধু ভাষারও আজ চল নেই। ১০০ বছর পরেও পাঠক বইটি পড়ছে কেন... বইটি আমাদের ইতিহাস। আর তার চেয়েও বড়, বইয়ে তারাশঙ্কর যে সত্যকে উপস্থাপন করেছেন তা এখনো অক্ষুন্ন রয়ে গেছে শত বছর পরেও। বাঙালি চরিত্র, বাঙালি সংস্কার, সমাজ-ব্যবস্থা সব কিছুর ভোল পাল্টে গেলেও ভিতরের ডিএনএটা একই রয়ে গেছে। তাই বইটি রিলেট করতে একটুও কষ্ট হয় না। দিস ইজ পিউর গোল্ড!
বইটি আমার কাছে থ্রিলারের মত লেগেছে। ঘটনার শুরু একটা গোলমাল দিয়ে। এবং ঘুরেফিরে এই গল্পে বারবার গ্রাম সমাজের বিভিন্ন বিপর্যয় উঠে এসেছে। একটা ক্রাইসিস সব সময় উপস্থিত ছিল। এই গল্পটা বিভিন্ন পেশার মানুষের টিকে থাকার লড়াই নিয়ে। কারো জন্য লড়াইটা সহজ, কারো জন্য খুব বেশি স্যাক্রিফাইসিং। শত বছরের পুরনো সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছে যন্ত্রচালিত কল। মানুষের চাহিদা শুধু ধানের সময় ধান, আর কলাইয়ের সময় কলাইয়ে সীমাবদ্ধ নেই। বিংশ শতাব্দীতে আধুনিকতার শুরু, তার ছোঁয়াচ লেগেছে সর্বত্র। আর তাই জমিদারেরও চাই মাত্রাতিরিক্ত খাজনা। সব মিলিয়ে পিতৃপুরুষের পেশাটা ধরে রাখা সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। তারা কলে ছুটে খাটতে। কলকারখানা যারা তৈরি করল তারা হয়তো চেয়েছিল স্বয়ংক্রিয় জীবন ব্যবস্থা। কিন্তু কলে যারা চাকরি করতে ছুটল, তারা সবাই একটা সোনালী অতীতকে ইতি টেনে দিল অন্নের সংস্থানে। চাষবাস এদেশের মানুষের বহু শত বছরের পেশা। চাষকে ঘিরে জীবনের সমারোহ, উৎসব-পার্বণ, কিংবা শুভ দিনের গণনা। মাটিকে তারা বড় ভালোবাসে, মাটি মা, মাটি দেবী।
'চাষ আর বাস'। পল্লীর জীবনে দুইটা ভাগ। মাঠ আর ঘর–এই দুইটি ক্ষেত্রেই এখানে জীবনের সকল আয়োজন—সকল সাধনা। আষাঢ় হইতে ভাদ্র—এই তিন মাস পল্লীবাসীর দিন কাটে মাঠে—কৃষির লালন-পালনে। আশ্বিন হইতে পৌষ সেই ফসল কাটিয়া ঘরে তোলে—সঙ্গে সঙ্গে করে রবি ফসলের চাষ। এ সময়টাও পল্লীজীবনের বারো আনা অতিবাহিত হয় মাঠে। মাঘ হইতে চৈত্র পর্যন্ত তাহার ঘরের জীবন। ফসল ঝাড়িয়া, দেনা-পাওনা মিটাইয়া সঞ্চয় করে, আগামী চাষের আয়োজন করে; ঘরের ভিতর-বাহির গুছাইয়া লয়। প্রয়োজন থাকিলে নূতন ঘর তৈয়ারি করে, পুরানো ঘর ছাওয়ায়, মেরামত করে; সার কাটিয়া জল দেয়, শন পাকাইয়া দড়ি করে। গল্প-গান-মজলিস করে, চোখ বুজিয়া হরদম তামাক পোড়ায়, বর্ষার জন্য তামাক কাটিয়া গুড় মাখাইয়া হাঁড়ির মধ্যে পুরিয়া জলের ভিতর পুঁতিয়া পচাইতে দেয়। চাষীর পরিবারের যত বিবাহ সব এই সময়ে—মাঘ ও ফাল্গুনে। জের বড় জোর বৈশাখ পর্যন্ত যায়। হরিজনদের চৈত্র মাসেও বাধা নাই, পৌষ হইতে চৈত্রের মধ্যেই বিবাহ তাহারা শেষ করিয়া ফেলে।
এই অশিক্ষিত ক্ষুধার্ত জনগোষ্ঠী তাদের উপরে আসা পরিবর্তনকে কিভাবে মোকাবেলা করছে, তা বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন তারাশঙ্কর। চরিত্রগুলো বেশ লেগেছে—অনিরুদ্ধ কর্মকার, দেবু পণ্ডিত, দুর্গা, তাদের আমরা আজও দেখতে পাই। দেখতে পাই যতীনকে, জগন ডাক্তারকে।
শ্রীহরি ঘোষের চরিত্রটি দারুন। ক্লাসিক যাকে বলে। পড়তে পড়তে মনে হলো কত শ্রীহরি ঘোষ দেখলাম জীবনে। পরের আত্মসাৎ করে নিজের গণ্ডি বাড়ানো, তারপর সাধু বনে যাওয়া, মসজিদ বা মন্দির প্রতিষ্ঠা করা। মানুষের হক কেড়ে নিয়ে, তারপর পকেট থেকে দশটা টাকা বের করে দিয়ে খুব দরদী আত্মা হওয়ার চেষ্টা। শ্রীহরি ঘোষ আমাদের বড্ড চেনা। তিনি পুরাতন হলেন না এখনো।
কিন্তু আমজনতা ছিরু দাস কিংবা শ্রীহরি ঘোষকে অগ্রাহ্য করে কি করে। পয়সাই সব। তা তো ব্রতকথাতেই বলা আছে।
মা লক্ষ্মীর নাম শ্রী। শ্রী যার আছে—তারই শ্রী আছে; সে মনে বল; চেহারায় বল; প্রকৃতিতে বল।
ঝড়ের বেলা বাড়ি ফিরতে গিয়ে সেটা অনিরুদ্ধও উপলব্ধি করতে পারে—
সাপ কি অপর জানোয়ারকে সে ভয় করে না, ভয় তাহার মানুষকে। ছিরুকে আগে গ্রাহ্য করিত না। কিন্তু শ্রীহরি এখন আসল কালকেউটে।
আর তখনই মানুষ আকাঙ্ক্ষা করে এক দেবতার, যে কিনা সকলের জন্য ভাবে। সেই হলো গণদেবতা।
তারাশঙ্কর পরে বোরড হওয়ার কোন জায়গা নেই। এখনো রিলেট করা যায়, যাবে ততদিন—যতদিন টিকে থাকার লড়াই চলবে।
Comments
Post a Comment