বোবা কাহিনী: বুক রিভিউ
বই: বোবা কাহিনী
বই লেখক: জসীম উদদীন
পল্লীকবি জসীম উদদীনের বিভিন্ন লেখা পড়া হয়েছে তার কাব্যগাথা সোজন বাদিয়ার ঘাট, নকশি কাঁথার মাঠ, আবার তার বাঙালির হাসির গল্প, বিদেশ নিয়ে লেখা স্মৃতিকথা থেকে। কিন্তু পল্লী জীবন নিয়ে পুরোদস্তুর উপন্যাস যে তিনি লিখেছেন, জানা ছিল না। গুডরিডস ফ্রেন্ড আবিদের রিভিউ দেখে জানতে পারলাম।
খেজুরপাটি বিছিয়ে যেমনি বসতে দেয় গ্রামে, তেমনি নকশা করা একটা পাটির ছবি বইয়ের প্রচ্ছদে। দু’শ পাতার খানিকটা কম এই বই। ক্লাসিক্যাল বাংলা উপন্যাস পড়া হয়েছে বিভূতিভূষণের, তারাশঙ্করের, মানিকের। বাংলার দৈন্য গ্রাম সমাজের সাথে পরিচয় হয়েছে সেখান থেকেই। তবে সেকালের মুসলমান গ্রাম সমাজ নিয়ে বেশি একটা পড়া হয়নি, ওই পরীক্ষা পাশ দিতে হাজার বছর ধরে ছাড়া। বাঙালি মুসলমানদের এবং ঠিক আমার দাদাবাড়ি এলাকার ও পাবনা-সিরাজগঞ্জের লোকজনের মুখের ভাষার উক্তি দিয়ে একটা দারুণ বই পড়তে পারবো, ভাবি নি। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল কাটাচামচ, ছুরি ফেলে দিয়ে হাত মাখিয়ে পেট ভরে ডাল ভাত খাচ্ছি। এমনই সরল ও অন্তরগামী এই জনপদের কথা—তাদের মুখের ভাষা এমনই মায়া কাড়ে। সারিন্দার মতো বেজে চলে তার সুর শহুরে পাঠকের অন্তরে। গ্রামের সেই বোবা মাটি যার বুক চিরে সোনা ফসল ফলে, লাঙ্গল দেয়া বলদ গাই গরু দুটি, কাঁঠাল কাঠে বানানো সারিন্দা ও তার উপরে একটি পাখি—এই বোবা অস্তিত্বের কথা পাঠকের কাছে পৌঁছে যায় উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে।
কৃষক আজাহেরকে নিয়ে বইয়ের গল্প শুরু হয়। তারপর তার পরিবার। খুব মজা লাগলো তারা কিভাবে তাদের পরিবারকে সম্বোধন করে জেনে। আমাদের বাবা মারা যেরকম একে অপরকে ডাকে—অমুকের মা, অমুকের আব্বা বলে, ওপার বাংলায় “ওগো শুনছ” এমনটাও বলার চল আছে। আজাহেরের অঞ্চলে তারা বলে “আমাগো বাড়ির উনি”। আর আমাগো বাড়ির উনির সাথে তারা তৃতীয় পুরুষে কথা বলে। যেমন “আমাগো বাড়ির উনি কি ভাত খাইছে,” যার অর্থ দাঁড়ায় “বউ, ভাত খেয়েছ?”
এমনই সরল তাদের জীবন। শরমে মরিয়া যায় তাহারা ঘরণীর সাথে মুখ ফুটে কথা বলতে।
বেচারী আজাহের! কত মাঠের কঠিন বুক সে লাঙলের আঘাতে ফাড়িয়া চৌচির করিয়াছে—কত দৌড়ের গরুকে সে হেলে-লাঠির আঘাতে বশে আনিয়াছে। কত দেশে-বিদেশে সে পৈড়াত বেচিয়া কত বড় বড় লোকের সঙ্গে কথা কহিয়াছে, কিন্তু যে তাহার সারা জীবনের সঙ্গী হইয়া তাহার ঘর করিতে আসিল, তাহার সঙ্গে কথা কহিতে আজাহেরের সাহসই কুলাইয়া উঠিতেছে না, কি করিয়া সে কথা আরম্ভ করে—কোন্ কথা সে আগে বলে কিছুই তাহার মনে আসিতেছে না।
তাদের সীমিত চাওয়া পাওয়ার কথা ভেবে অবাক হয়ে যাই—
অনেক বড় হইতে তাহারা চাহে না। মাথা গুঁজিবার মত দু’খানা ঘর, লাঙল চালাইবার মত কয়েক বিঘা জমি আর পেট ভরিয়া আহার ;—এরি স্বপ্ন লইয়া তাহারা কত চিন্তা করে, কত পরামর্শ করে, কত ফন্দি-ফিকির আওড়ায়।
তাহার পরিবারে যেমন তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে তেমনি এই গরু দুইটি। এদের সঙ্গে সে কথা কহিতে পারিত। এই বোবার ভাষাও সে হয়ত কিছু বুঝিতে পারিত। তার সকল সুখের সঙ্গে সকল দুঃখের সঙ্গে সমসুখী সমদুখী হইয়া ইহারা তাহার স্বল্প পরিসর জীবনটিতে জড়াইয়াছিল।
উপন্যাসের ঘটনার মধ্যে চলে আসে সে সময়ের সমাজ ব্যবস্থা, ধর্ম, আচার অনুষ্ঠান। ইসলামের প্রচার প্রসারে যেভাবে ব্যবসায়িক ব্যবহার হতো, সেটা এতো প্রাসঙ্গিক ছিল।
“খোদা তায়ালা জাল্লা জালালুহু পাক পরওয়ারদেগার কোরান শরিফমে ফরমাইছে, ” এই পর্যন্ত বলিতেই গাঁয়ের এক বৃদ্ধ লোক আহা–হা করিয়া কাঁদিয়া উঠিল,
অশিক্ষিত চাষা-ভুষো, তারা পড়তে জানে না। মওলানাদের মুখের ভাষাই তাদের কাছে কোরআনের মত সত্য। এদেশের মানুষ পালা-পর্বণে গীত শুনে, নৌকা বাইচ করে। তাদের পূর্বপুরুষের পেশা ও গ্রাম জীবনের এন্টারটেইনমেন্টও বটে। মওলানার ওয়াজ যখন তার চূড়ান্ত ইতি ঘটাতে চায়, অশিক্ষিত মানুষও হক-কথায় দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে।
“কিন্তুক মোড়ল সা’ব ! আল্লার দোজগের জ্বালা কি দুনিয়ার দোজগের চায়াও বিষম? আমার পুলা–ম্যায়ারা কুনুদিন বাতের দুঃখু পায় নাই। কাইল তারা যখন বাত বাত কইরা কানবি, আমি খাড়ায়া খাড়ায়া তাই হুনব, আল্লার দোজগে কি ইয়ার চায়াও দুষ্কু?”
পাক ভারতে মুসলিম রাজত্ব শেষ হইবার পর একদল মাওলানা এদেশ হইতে ইংরেজ তাড়ানোর স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন। সহায়-সম্পদহীন যুদ্ধ-বিদ্যায় অনভিজ্ঞ সেই মুসলিম দল শুধুমাত্র ধর্মের জোরে সে যুগের ইংরেজ-রাজের অত্যাধুনিক অস্ত্র-সজ্জার সামনে টিকিয়া দাঁড়াইতে পারিল না। খাঁচায় আবদ্ধ সিংহ যেমন লৌহ-প্রাচীর ভাঙিতে না পারিয়া আপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়িয়া খাইতে চাহে, সেইরূপ এই যোদ্ধার দল নানা সংগ্রামে পরাজিত হইয়া হৃত-সর্বস্ব হইয়া ক্ষোভে দুঃখে আপন সমাজ দেহে আক্রমণ চালাইতে লাগিল। স্বাধীন থাকিতে যে মুসলিম সমাজ দেশের চিত্র-কলায় ও সঙ্গীত-কলায় যুগান্তর আনয়ন করিয়াছিল, আজ তাহারাই ঘোষণা করিলেন গান গাওয়া হারাম—বাদ্য বাজানো হারাম, মানুষ ও জীব-জন্তুর ছবি অঙ্কন করা হারাম।
গরিব কৃষক ঠকে ঠকে শেখে যে ছাওয়াল-পাওয়ালগের ল্যাহাপড়া না শিহালি তাদের অপমানটার বদলা নেওয়া হবে না।
মাস্ষ্টারের নির্দেশ মত রান্না করা হাঁড়ীর পিছনে লাউপাতা ঘসিয়া তাহাতে পানি মিশাইয়া তাহারা কালি তৈরী করিয়াছে। তাহা দোয়াতে ভরিয়া সেই দোয়াতের মুখে রশি বাঁধিয়া হাতে করিয়া ঝুলাইয়া লইয়া তাহারা স্কুলে চলিয়াছে। খাগড়া-বন হইতে লাল রঙের খাগড়া বাছিয়া তাহা দিয়া কলম তৈয়ার করিয়াছে। আর কলা পাতা কাটিয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া লইয়াছে। তাহার উপরে মাষ্টার মহাশয় ক, খ প্রভৃতি বর্ণমালা লোহার কাঠি দিয়া লিখিয়া দিবেন। তাহারা উহার উপরে হাত ঘুরাইয়া বর্ণমালা লেখা শিক্ষা করিবে।
আগে হাঁটাপথে স্কুলে যাতায়াত করিতে হইত। তাহাতে স্কুলে পৌঁছিতে তাহাদের এত ঘন্টা লাগিল। এখন ধান খেতের পাশ দিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাও দাড়া দিয়া নৌকা চালাইতে হয়। তাই দেড় ঘন্টার আগে তাহারা স্কুলে পৌঁছিতে পারে না। যেদিন বৃষ্টি হয় একজন বসিয়া বুকের তলায় বই-পত্রগুলিকে কোন রকমে বৃষ্টির হাত হইতে রক্ষা করে। কিন্তু তিনজনেই ভিজিয়া কাকের ছাও হইয়া যায়। সেই ভিজা জামা কাপড় শুদ্ধই তাহারা স্কুলে যায়। স্কুলে যাইয়া গায়ের জামা খুলিয়া শুখাইতে দেয়। পরনের ভিজা কাপড় পরনেই থাকে।
এ যেন ট্রেনে চলতে চলতে বাবার মুখে শোনা তার সেই বছরে-ন’-মাস-পানিতে-ডুবে-থাকা সিরাজগঞ্জের এক গ্রামের ছেলেবেলার কাহিনী। আবার কখনো চোখে জল আসে গ্রামের অকৃত্রিম জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের ধাক্কা দেখে।
“আমাগো গান কেউ পোছেও না। দিনি দিনি বাপু কাল বদলায়া যাইত্যাছে। এহন এসব গান কেউ হুনবার চায় না। ওই যে থিয়েটার না কি কয়, নাচনাআলীরা যে সব গান গায় লোকে হেই রহম গান হুনবার চায়। তা হে গান ত আমার জানা নাই।”
এ যেন মায়ের পিঠা বানানোর নাট্যভিনয় ! মাকে এই পিঠা বানাইতে তাহারা কতবার দেখিয়াছে, দেখিয়া দেখিয়া তবুও তৃপ্তি হয় না। শীতের দিনে মা শেষ রাতে উঠিয়া ভাপা–পিঠা বানায়। ছেলে–মেয়ে দুইটি মায়ের সঙ্গে উঠিয়া কতবার তাকে ভাপা–পিঠা বানাইতে দেখিয়াছে।
এই জায়গাটা পড়ে মনে হল নানিবাড়িতে এভাবে আমরা নানীকে কত পিঠা বানাতে দেখেছি। তেল-পিঠা খুব পছন্দ ছিল, নারকেলের খোলের মধ্যে পিঠার পুর নিয়ে নানী চুলায় দিতেন। সেই স্মৃতিটা মনে পড়ে যায় এইটুকু পড়ে।
জসীমউদ্দীন বুঝি তার লিখায় কাব্য না করে থাকতে পারেন না। তাই উপন্যাসের বাক্যগুলোর মাঝেও কবিতা আটকে আছে।
দিনে দিনে হায়রে ভাল দিন চইলা যায়। বিহানের শিশির ধারা দুপুরে শুখায়। বারো জঙ্গ করে মর্দ্দ কিতাবে খবর, তের জঙ্গ লেখা যায়রে টঙ্গির শহর।
অশিক্ষিত জনপদের এই সরল সাধারণ জীবন, তাদের জীবনের যুদ্ধ—আজকে শহুরে ব্যস্ত দিন শেষে, সম-অধিকার, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এর সিভিল যুদ্ধ শেষে, যখন বইয়ের পাতায় পড়ি, কতই কনট্রাস্টিং মনে হয়। তাদের সেই গল্পটা এখন অন্যরকম একটা অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। ভীষণ ভীষণ মায়াবী লাগলো তাদের এই বোবা কাহিনী।
Comments
Post a Comment