পাহাড়, বৃষ্টি ও তিতলি
মুভি টাইটেল: তিতলি
পরিচালক: ঋতুপর্ণ ঘোষ
মেঘ পিয়নের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা
মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা
খুব মেঘ করে আসা বাদলা দিনে লিভিং রুম যখন আঁধার হয়ে গেছে, আমি ছুটির দিনটা বসে বসে ভাবছি কি মুভি দেখা যায়। ঘুরে ফিরে ঋতুপর্ণ ঘোষের দেখা মুভিগুলোই আবার দেখবো, তাও নতুন কিছু ব্রাউজ করছিলাম। তারপর বুঝলাম, হবে না, মুড খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ঋতুপর্ণর সেকশনটায় এসে একটা কিছু পিক করি। তিতলি দেখা শুরু করলাম। কত নাম্বার রিওয়াচ মনে নেই তবুও গল্পটা যখন শুরু হচ্ছিল, মনে হল অনেক কিছু প্রথমবার দেখছি। এইটাই বুঝি ভালো একটা মুভির বৈশিষ্ট্য।
অপর্ণা সেন ও কঙ্গনা সেন শর্মা—সত্যিকারের মা, মেয়ে এই সিনেমাতেও মা-মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছে। ঋতুপর্ণ ঘোষ কঙ্কনাকে বলেছিলেন যে, তোর জন্য একটা আলাদা স্ক্রিপ্ট ভেবে রেখেছি। তার মাকে নিয়ে তো তিনি আগেও মুভি করেছেন। এটা কঙ্গনাকে নিয়ে করা, সাথে মাও আছেন।
ঋতুপর্ণ’র প্রত্যেকটা মুভিতে একটা ডিস্টিংক্ট আবেগ কাজ করে। এই মুভির আবেগটাকে কি করে বোঝাই—একটা ফেলে আসা সময়ের জন্য মন কেমন করা, মা ও মেয়ের সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা। পাহাড়ি চা বাগান আর কুয়াশার মাঝে দূর থেকে মৃদু হয়ে আসা পাহাড়ি জনপদের বাজনার তালটা স্নায়ুকে কেমন নিস্তেজ করে দিতে থাকে। মুভির মধ্যে দু-তিনটে কবিতা ঘুরে ফিরে আসে, একটা গানই বিভিন্ন লিরিক্স নিয়ে বিভিন্ন সময় বাজতে থাকে। সবকিছু এত এত আবেগকে ছুঁয়ে যায়—আমি জানি না ঋতুপর্ণ এটা কেমনে করতেন।
কুয়াশা, মেঘ, বৃষ্টি ছায়া দুটো দিনের মধ্যে পুরো মুভিটা শেষ হয়ে যায়। চা বাগানের একটা ছিমছাম বাংলোতে কন্যা ও তার বাবা-মার বসবাস। মেয়েটা একটা ফিল্মস্টার এর অনেক বড় ফ্যান। তার ঘর জুড়ে পোস্টার। পাহাড়ে ম্যাগাজিন আসে ডাকে করে। সকালবেলা ব্রেকফাস্ট ও চা খেয়ে মা মেয়ে তৈরি হয়ে নেয়, তারা যাচ্ছে এয়ারপোর্টে বাবাকে রিসিভ করতে। বাবা ফিরছেন কোন একটা বিজনেস ট্রিপ থেকে মুম্বাই হয়ে। তাদের জিপ পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে নামতে থাকে। দার্জিলিংয়ের চা-বাগান, বিশাল বড় গাছ, পাহাড়। ছেলেমেয়েরা ইউনিফর্ম পড়ে স্কুলে যাচ্ছে। গাড়ি কখনো থামছে, আর সামনে দিয়ে স্টিম-ইঞ্জিন চালিত শত বছরের পুরনো ট্রেন পার হয়ে যাচ্ছে। মা মেয়ের কথোপকথন হচ্ছে—এটা তোমার নতুন শ্যাম্পু, মা? কেমন সুন্দর একটা গন্ধ তোমার গায়ে। সহজ একটা সম্পর্ক মা-মেয়ের মধ্যে, গান নিয়ে কবিতা নিয়ে তারা তর্ক বিতর্ক করে। মেয়ে গান শুনতে চায় মার কাছে, মা তাকে কবিতা বলে শোনায়। মনে হচ্ছিল অপর্ণা সেনকে নিজের মা হিসেবে পেলে যে রকম একটা মুগ্ধতা কাজ করে, তিতলি চরিত্রটাও তেমনি মুগ্ধ মায়ের ওপর।
তারপর দিনটা একটু অন্যরকম গড়ায়। রাস্তায় একজন আগন্তুক লিফট চায় গাড়িতে। তিনিও যাবেন এয়ারপোর্টে, তার গাড়ির টায়ার নিয়ে গোলমাল—এরকম কিছু একটা। তাই বাধ্য হয়ে উঠতে হয় তাদের গাড়িতে। গল্পের এই বাঁকটাও ভীষণ সুন্দর। ভীষণই কাব্যময়, মন উতলা করে দেওয়া।
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারো মাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরান্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে
মুভির এই বাঁকের গল্পটা নাই বলি। সেটা স্ক্রিনে দেখা যাবে। শেষের দিকের একটা দৃশ্যের কথা বলি—এটা আমার খুব প্রিয়। রাতের একটা দৃশ্য। মা-মেয়ে কথোপকথন করছে। হঠাৎ দমকা লাগানো হাওয়া শুরু হয়েছে, মা উঠে গেছে জানালা বন্ধ করতে। হাওয়ায় মার গা থেকে চাদরটা সরে গিয়ে তার নাইটি দেখা যাচ্ছে। তিতলি অর্থাৎ কঙ্কনা, ভীষণ শকড হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। টিনেজার মেয়েটির উপলব্ধি হয়, যে তার মধ্যে যে আবেগ কাজ করে, তার মধ্যে জীবন-প্রেম এসব নিয়ে যে উত্তেজনা, সেই বয়সটা তার মারও ছিল কিংবা এখনো আছে। সবসময় যে মা, যে বন্ধু তার মধ্যে যৌবনের মূর্তি দেখতে পেয়ে ভীষণ হকচকিয়ে গেছে সে, মাও চাদর দিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেলে তাড়াতাড়ি করে।
প্রিয় কিছু দৃশ্য আটকে রাখলাম এইখানে।
আবার কোন মেঘলা দিনে দেখবো, আবারো মনে বয়ে যাবে সেই অনুভূতিগুলো।
Comments
Post a Comment