অলৌকিক জলযান/বই রিভিউ



বই লেখক: অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

সমুদ্র ও জীবনের ছেদবিন্দুতে লেখা এক মহাকাব্য। 


নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাসের সোনা দেশভাগের পর চলে আসে ভারতে। কৈশোর থেকে যুবা বয়সের মাঝামাঝি সময়। নিজের যোগ্যতা দিয়ে ছিন্নমূল পরিবারের হাল ধরার ভীষন তাগিদ। দুবেলা পেট ভরে ভাত আর সেইলরের সাদা পোশাকে বাবা-মাকে গর্বিত করার আশা নিয়ে জাহাজে উঠে আসে সোনা। আমাদের সোনাবাবু— সোনালী বালির নদীর চর, যেখানে সে বালির মধ্যে গর্ত করে একটা মালিনী মাছ বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল, সেই নদী, সেই তরমুজ ক্ষেত পেরিয়ে সে এখন অন্তহীন সমুদ্রে এস. এস. সিউল-ব্যাংক জাহাজের নাবিক। জাহাজে সবাই তাকে ডাকে ছোটবাবু বলে। সমুদ্রের বিশালত্বে কিংবা নতুন জীবনের অভ্যস্ততায় এক সময় তার মনেই থাকে না, তার একটা দেশ আছে পৃথিবীর অপর প্রান্তে, সেখানে তার বাবা-মা, ভাইবোন কতো আলাদাভাবে জীবন কাটাচ্ছে। 


সাদা জাহাজটাকে সে কিছুতেই ভাবতে পারে না জাহাজ, আসলে সেই সৌরলোকের অন্তহীন যাত্রার মতো মনে হয়, যেন চারপাশে সব গ্রহ নক্ষত্র, উপগ্রহ আর এক সৌরলোক থেকে অন্য সৌরলোকে একটা যান অনবরত ছুটছে। 


দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় বন্দরে বন্দরে বিরতি। জাহাজীরা চিঠি পায় বন্দরে পৌঁছুলে। বাদশা মিয়ার চার নম্বর বউ চিঠি লিখে পাঠায়। মৈত্রদা বাংকে শুয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বউয়ের চিঠি পড়ে। সবার চিঠি আসে। শুধু চিঠি আসে না ছোটবাবুর। রিফিউজি পরিবারটির ঠিকানা আজ এখানে, কাল সেখানে। ছোটবাবু দেখছে সমুদ্রের বিচিত্র জীবন, সমুদ্রের গর্ভে তিমি মাছের ছোটাছুটি, দেখছে জাহাজ মিসিসিপি নদীতে পড়ছে, কিন্তু জানাতে পারছে না কাউকে। বলতে পারছে না, মা, আমরা এখন মিসিসিপি নদীতে। 


এত সুন্দর কাব্যের আঙ্গিকে বাংলা সাহিত্যে কোনো পুরুষ চরিত্রের উপস্থাপন দেখিনি আগে। সোনাবাবু কিংবা জাহাজের ছোটবাবু, তাকে নিম্নস্তরের জাহাজীদের কাতারে ফেলে দেওয়া যায় না। মনে হয়, একটা সময় খুব বনেদি পরিবারের ছেলে ছিল। সেই চন্দন কাঠের সুবাস গায়ে। ছোটবাবুর শরীরের সুষমা অধীর করে দেয় বনিকে- 


যেন জীবনের এক আশ্চর্য মোহ অথবা ঘ্রাণ বলা যেতে পারে, অথবা রাজার রাজা ছোটবাবু, এবং শরীরের সর্বত্র মহিমময় ঈশ্বর কোন কৃপণতা রাখেন নি। এক আশ্চর্য মোমের শরীর, অথবা পাথরের মূর্তি। ... ছোটবাবুর মুখে নীল দাড়ি। শরীরের লাবণ্য কোনো দূরবর্তী এক বনভূমির কথা অথবা কোন মরুভূমিতে একজন মুসাফিরের নিত্য হেঁটে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। 


কতো রকম ব্যক্তিত্বের মানুষ এই জাহাজে। জাহাজের কাপ্তান স্যালি হিগিনস। তার একটাই দায়িত্ব—ঝড়ঝঞ্ঝা সবকিছু থেকে জাহাজকে বন্দরে পৌঁছে দেওয়া। সাদা চুল, নকল দাঁত, কাপ্তান এর সাদা ইউনিফর্ম, কাঁধে চারটে সোনালী স্ট্র্যাপ। পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে ব্যবহারের মাঝে বিরাজ করে প্রাজ্ঞতা। কাপ্তান স্যালি হিগিনস, এস.এস.সিউল-ব্যাংক‌ আন্ডার হিজ কম্যান্ড। 


দেখি এন্জিন সারেং এর মতো বিশ্বস্ত মানুষ। কাজকর্ম শেষে সে তার কোরান খুলে বসে। আবিষ্ট মনে সূরার আয়াত পড়ে যাচ্ছে। তার পৃথিবীতে এর বেশি কিছু লাগে না। 


জাহাজে চড়ে বসে একজোড়া চড়ুই পাখি। তারাও যোগ হয় জাহাজের যাত্রী কিংবা এই উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে। যোগ হয় এক অ্যালবাট্রস যুগল। আর পুরোটা উপন্যাস জুড়ে প্রতাপশালী হয়ে রয়েছে সমুদ্র। কি মনোরম বর্ণনা- 


কেননা, সমুদ্র সেই কবে থেকে, কেউ বলতে পারে না, পৃথিবীতে অথবা সৌরজগতে বড় সে একা! একাকী সে, আছে তার মতো, সে কখনও উত্তাল তরঙ্গমেলার ভেতর আকাশের নক্ষত্রদের ছুঁয়ে দিতে চায়, তার কি যে প্রলোভন তখন। 


নোনা জলে ভাসতে ভাসতে ডাঙা তখন দুর্লভ বস্তু জাহাজীদের কাছে। কোথাও একটা দ্বীপ চোখে পড়লে বা বন্দরের আবছা অবয়ব দৃষ্টিসীমার মধ্যে আসলে, জাহাজীরা সব কাজ ফেলে, ডেকে এসে দাঁড়ায়। কাজ ফেলে দূরবীন লাগিয়ে বসে থাকে ডেবিড।‌ অথবা কখনো কাজের তাড়া থাকলে ছোটবাবুকে বসিয়ে রাখে দূরবীন নিয়ে। এনি ওম্যান ছোট? সমুদ্রে নাকি জীবনধারণের জন্য ঈশ্বর সবই দিয়ে রেখেছেন। তবে আসল জিনিসটাই কিনা নেই। ওম্যান। 


একনাগাড়ে মাসাধিক শুধু জলে ভেসে থাকতে থাকতে বন্দর এলে জাহাজীরা 'প্রকৃত জাহাজী' হয়ে যায়। দাদার মতো শাসন করে, ছায়া দিয়ে রাখে মৈত্রদা। ‌বন্দর এলে মৈত্রদা 'জাহাজী মৈত্র' হয়ে যায়। এই জায়গাটায় চৌরঙ্গী বইয়ের সাথে মিল পেয়েছি। হোটেল শাজাহানে বিত্তশালীরা যেমন আদিম রিপুর তাড়নায় বেসামাল হয়ে যেতো, বন্দরে তেমনি জাহাজীরা আদিম রিপুকে ব্রেক কষাতে পারে না কোনো কিছু দিয়েই।‌ 


চারিদিকে শুধু সমুদ্রের ঢেউ আর আকাশ। তার মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে সাদা জাহাজ। জাহাজের কলকব্জা, কতো রকমের মাস্তুল, ডেক—সব যার্গন এতো সাবলীলভাবে কথায় কথায় টেনে এনেছেন অতীন বাবু। চোখের সামনে চলে আসে অতিকায় পিস্টন, জাহাজের পিচিং। কিছুতেই মনে হয় না, জাহাজটা শুধু একটা জাহাজ। মনে হয় এরও প্রাণ আছে। মানুষ যেভাবে বাঁচে অক্সিজেন দিয়ে, জাহাজটা তেমনি কয়লা টেনে নিচ্ছে প্রশ্বাসে। কোথাও এর একটা আত্মা না থেকে পারে না। অন্তত এমন একটা বিশ্বাস জন্মে যায় নাবিকের মনে। 


সাড়ে চারশো পৃষ্ঠাব্যাপী এই উপন্যাস। তবুও এর ব্যপ্তি আরো গভীর। ষাটের দশকের এস. এস. সিউল-ব্যাংক পাঠককে গোটা পৃথিবীটাই ঘুরিয়ে আনবে। ভারত মহাসাগর, আটলান্টিক, মিসিসিপি নদী হয়ে ছবির মত দ্বীপ তাহিতি। সমুদ্রের জলের নিচে ফসফরাস জ্বলে উঠলে মনে হয় নক্ষত্রপুঞ্জ ঝলমল করছে জলের নিচে। সমুদ্র ও আকাশের অসীমতায় ডুবে  পরিক্রমণ করে আসা হয় ব্যক্তি-জীবনের গণ্ডিও। প্রকৃতি ও মানুষের কি অক্ষুন্ন আদিমতা। অনন্ত পারাবারকে প্রদক্ষিণ করে বয়ে চলে এই মহাকাব্য।


Comments

Popular Posts