অক্ষয় মালবেরি: রিভিউ

বই টাইটেল: অক্ষয় মালবেরি 

বই লেখক: মণীন্দ্র গুপ্ত



মালবেরিঝোপের চৌদিক দিয়ে নাচতে নাচতে
কখন যে পরিশ্রান্ত বসেছি—কখন বেলা শেষ
চড়ুইভাতির ভাত খুঁটে খেয়ে কখন যে চড়ুই পালাল
শুধু উনুনের পোড়া কাঠ—অঙ্গারের কালো—

সংসারবেলার সাক্ষী।


খুব আবছা অক্ষরে ছাপা একটা কবিতার কয়েকটা লাইন বইয়ের প্রথম পাতায়। লাইনগুলো ঠিকঠাক লিখলাম কিনা, এত অস্পষ্ট একটা ছবি, তবু পড়ার পর ভিতরে একটা নাড়া দিয়ে যায়—কি যেন একটা নেই, হারিয়ে গেছে—এমন অনুভূতি।


বইয়ের লেখা একটুখানি পড়ে মনে হল, একি জীবনানন্দের লেখা কোন গদ্য? একটা স্মৃতিকাতর, মন খারাপ করা অনুভূতি হয় বই পড়তে গিয়ে। একটা ঘোর কাজ করে, আর পরে জানতে পারলাম মণীন্দ্র গুপ্ত কবি ছিলেন, তখন বুঝলাম গদ্যের মাঝেও কেন কবিতার রেশ পাই‌।


আত্মজীবনী বলতে আমরা মনে করি ব্যক্তিগত পরিবার জীবনের হিসাব ও ইতিহাস। কিন্তু এই আত্ম তো ব্যক্তি ও পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। মণীন্দ্র গুপ্ত তার জীবনীতে তার আশেপাশের মানুষদের, জনপদের, সংস্কৃতির ছোট ছোট জীবনী লিখে ফেলেছেন। তাই মনে হয় না যে আমি কবি মণীন্দ্র গুপ্তকে পড়লাম। মনে হয় আমি ওই সময়টার ডজন খানেক মানুষের দৈনন্দিন জীবন কেমন কাটতো, বা মধ্যবিত্ত পরিবারের কিরকম সংস্কৃতি চর্চা ছিল, দশটা পেশার মানুষ কেমনে জীবনযাপন করত—সবকিছু নিয়েই একটা ধারণা পেলাম।


গল্পতে বেশ এলিমেন্ট আছে। ঠিক যেমন ক্লাসিক্যাল সাহিত্যে থাকে। তবে বিভূতিভূষণ বা তারাশঙ্করের লেখায় যেমন একটা গাম্ভীর্য থাকে, মানে খুব কিউরেট করে লিখা, এই লেখাটা তেমন নয়, বেশ খোলামেলা। বৈঠকখানায় আড্ডা দিতে গিয়ে যেমন গল্প করা যায়, সে রকম ভাষা। তাই পড়তে লাগছিল দারুন।


আমি কত বাংলা বইয়ে এই রেফারেন্সগুলো পেয়েছি—বেতের ডগা, গিমা শাক, কত রকম পাখি, কত রকম গাছ—হিজলের ফুল, ডুমুরের ফুল। বাংলাদেশে থাকলেও চিনি না কোনটা কি গাছ, বা সেসময়কার খাবারগুলোর থেকে যোগাযোগ অনেক কমে এসেছে, মনে করতে পারি না কবে শেষ পান্তা ভাত খেয়েছি। আমি বইয়ের জগতে যে গ্রামবাংলায় ঘুরি, তা বুঝি আজ আর পাওয়া মুশকিল। প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্যতা কমে গিয়েছে, মাটির হাঁড়ি পাতিলের জায়গায় প্লাস্টিক। আবার ভ্যাকসিনের বদৌলতে অনেক অসুখ-বিসুখ কমে গিয়েছে, মানুষ বাড়িতে টয়লেট বানাচ্ছে। এই গ্রামের সাথে আমার যোগাযোগ অনেক কম। আমি যে গ্রামগুলোতে ঘুরি সাহিত্যের জগতে, যে খাবার, ফুল, ফল কে শুধু আমি ওই জগতেই পাই, ঠিক তেমন একটা গ্রাম অক্ষয় মালবেরি বইতে পেলাম।


বইয়ের দ্বিতীয় পর্বে এসে আরো খুশি হয়ে উঠলাম। এ পর্বে লেখক তার কৈশোরের বর্ণনা দিয়েছেন, তার কৈশোর কেটেছে সিলেটের ওইদিকে। বরিশালে শৈশব আর সিলেটে কৈশোর। সেই প্রায় শ’ বছর আগের শহর। এত কিছু জানলাম সেখানকার প্রকৃতি ও জনপদ নিয়ে। আরো ভালো লাগলো যে, একটা মধ্যবিত্ত জীবনের ধারণা পেয়েছি এই পর্বে, যেটা খুব রেয়ার ওই সময়কার বইগুলোতে। গ্রাম জীবন নিয়ে বই পড়েছি, নিম্নবিত্ত জীবনের দুঃখ কষ্ট নিয়ে পড়েছি। আবার তখনকার দিনে যারা আধুনিকতার ফ্রন্টলাইনার, তাদের কথা জেনেছি, ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস নিয়ে পড়েছি। কিন্তু যারা মাঝামাঝি, যারা বই লেখেন না আবার বইয়ের চরিত্রও না, যারা বইগুলো পড়েন, তেমন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কেমন ছিল সেই সময়ে, দারুন লেগেছে জেনে। অনেক মিল পেয়েছি পড়তে গিয়ে। কেমন বছর বিশেক আগে ফেলে আসা নিজের ছেলেবেলার কথা মনে হয়।


তৃতীয় পর্বে লেখক নিয়ে গেছেন আমাদের লাহোরে, ফৌজ বাহিনীতে। তিন দিন চার রাতের ট্রেনে করে কলকাতা থেকে লাহোর। রাভি নদীর পাশ দিয়ে চলে গেছে তার ট্রেনিং ক্যাম্প। নানা ভাষার, ধর্মের, অঞ্চলের ভারতীয়দের একসাথে ট্রেনিং চলে। তবে আলাদা রসুইখানা—শিখ, হিন্দু, মুসলমান দক্ষিণীদের। তবু এই ফৌজ বাহিনী ছিল একটি পরিবারের মত। সময়টা চল্লিশের শতক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, তাই দেশভাগের কথা তো উঠবেই।   শুধু দেশভাগ নয়, সেসময়ের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, লেখক যেখানে যেখানে থেকেছেন সেখানকার সাপেক্ষে উঠে এসেছে।


ফৌজ জীবনের পরের গল্পটা আর লেখেননি। এটুকুই মনে ভীষণভাবে গাঁথা হয়ে থাকবে।


কিছু প্রিয় লাইন রেখে যাচ্ছি 


আমি মুখ নিচু করে দুঃখকে খুজতাম, মাটিতে কোথায় সে গেঁথে আছে ভাঙা সবুজ বোতলের টুকরো হয়ে।


বোল থেকে কবে গুটি ধরেছে খেয়াল করি নি— হঠাৎ একদিন বড়মা মুঠো খুলে দেখাতেন একটি সবুজ কচি আম। আগন্তুক সেই প্রথম আমটি আমাদের গ্রীষ্মের নিশান। তারপর থেকে আমের পাতলা অম্বল, টক ডাল, ঘন চাটনি আমাদের খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনত।


তখন সূর্যাস্ত হচ্ছে। আমি নৌকো থেকে দেখছি খালের খাড়া উঁচু পাড়ের গা ঘেঁষে শুধু আকাশ— সেখানে মেঘ ফেটে গিয়ে গভীর আগুন ছড়িয়ে গেল, আর সেই আরক্ত আগুনমেঘের মধ্যে দুজন মাঝির ঝুঁকে পড়া সিলুএট পায়ে পায়ে চলে যাচ্ছে। খাড়া পাড়ের জন্য খেত মাঠ গাছ কিছু দেখা যায় না, শুধু আকাশ। 

    মানুষ কোথায় যায়?— এই কঠিন প্রশ্নের উত্তরে আমার মনে এখনো কেবল সেই ছবিটা আসে: লাল মেঘের মধ্যে দুজন মাঝি গুণ টেনে চলেছে।


আমি কি পাহাড়ের বাঁকে অজন্তা এলোরা বানাতে পারতাম? অসম্ভব। আমি উদয়গিরির চেয়েও অনেক ছোট একটা গুহা বানিয়ে ছেড়ে দিতাম। সেখানে বসে মেঘে— বর্ষায় বৃষ্টির রেখা, শীতে অস্তমান সূর্যের রেখা দেখতাম।


ক্রমশ যত দিন যেতে লাগল আমি এদের সঙ্গে মিশে যেতে লাগলাম। আমার বাক্সে চয়নিকা আছে, ফাল্গুনী আছে— তাতে কিছু যায় আসে না। সারা দিন একই পোশাক, একই খাওয়া, একই পরিশ্রমে ঘর্মাক্ত হই। রাত্রে, দশটার পরে আলো নিবে গেলে যার যার খাটিয়ায় শুয়ে ওরা গল্প করে। চার-পাঁচ জন অল্পবয়সী শিখ ছিল— হঠাৎ আমার অস্তিত্ব তাদের খেয়াল হল। মজা করে বলে— গুতোজি, একটু পাঞ্জাবী বলো। মজা করে আমিও বলি— আহো প্রাজী, কি অইয়া তেনু? কি অইয়া পুত্তর? ইত্যাদি ইত্যাদি। ঐ সরল যুবকেরা নিজেদের ভাষা বিদেশীর মুখে শুনে প্রাণ খুলে হাসে। আরো বলো, আরো বলো। আর দু-চারটে কথার পরই আমার স্টক ফুরিয়ে যায়। ঐটুকু যেন ছিল সারা দিনের শেষে ঘুমের আগের গুডনাইট চুমু।


বিদায়ের মুহূর্তে কিভাবে বিদায় নিতে হয় আমি জানি না। দুঃখে আমার মুখে কথা আসছিল না। হঠাৎ নিজেকে সেই চোরাকাদায় ডুবতে থাকা অন্ধকার রাতের হাতিটার মতো মনে হল। পরমুহূর্তেই মনে হল, ধ্যাৎ। মাথার উপর সিংহরাশি, লুব্ধক, ব্রহ্মহৃদয়, কালপুরুষ— বিরাট ছায়াপথ আছে না!— তারও উপরে নিশ্চয় আরও অসীম বেপরোয়া শূন্য।





একটা অলস বিকেলে, স্মৃতিকাতরতার কম্বলে জড়িয়ে, সমস্ত অনুভূতি সেই কথার রাজ্যে খেলা করতে থাকে, অক্ষয় মালবেরির পাতা খুলে।


Comments

Popular Posts